বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:১২ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক
সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসলেও কার্যত বিএনপির আন্দোলন সরকারের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। বিএনপির আন্দোলনের ধরন বা আন্দোলন করার সক্ষমতা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের উপহাসের পাত্রও হতে হয়েছে। ‘ঈদের পর সরকার পতনের আন্দোলন’— এক যুগ ধরে বিএনপি নেতাদের এমন হুংকার প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরলেও এবার তারা আসন্ন দুর্গাপূজার পর চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। এর অংশ হিসেবে ঢাকা শহরকেন্দ্রিক নানামুখী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে দলটি। কর্মসূচি সফল করতে রাজধানীতে ১০ লাখ লোক সমাগমের টার্গেট নিয়ে এগোচ্ছেন দলের শীর্ষ নেতারা।
দলটির নেতারা জানান, চূড়ান্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নে সুবিধা অসুবিধা সবকিছুই বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। পূজার পর আর গতানুগতিক কর্মসূচি নয়, সরকারের পতন ঘটাতে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা হবে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, আগামী ২৮ অক্টোবর থেকে সরকার পতনের নতুন কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকবে বিএনপি। নেতাকর্মীরা এটিকে সরকার পতনের শেষ ধাপের কর্মসূচি হিসেবে দেখছেন। নতুন এ কর্মসূচি ঘোষণার ১৫ দিনের মধ্যে আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে চাইছেন বিএনপি নেতারা। কর্মসূচি চূড়ান্ত করতে এরই মধ্যে বিএনপি ও এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর পাশাপাশি চলমান যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গেও দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে।
জানা গেছে, আগামী ১৮ অক্টোবর বিএনপি ঢাকায় যে সমাবেশ করতে যাচ্ছে সেখান থেকে সরকারকে পদত্যাগের জন্য সর্বোচ্চ এক সপ্তাহের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হবে। পূজার পর ২৮ অক্টোবর থেকে চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য মাঠে নামার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ঢাকাকে ঘিরে সরকার পতনের যাবতীয় কর্মসূচি চিন্তা করা হচ্ছে। চূড়ান্ত কর্মসূচিতে ছাত্র, যুব, পেশাজীবীসহ সরকারবিরোধী সবাইকে সম্পৃক্ত করতে জোর চেষ্টা চলছে। চূড়ান্ত কর্মসূচি সফল করতে ঢাকা মহানগরসহ আশপাশের জেলার সব পর্যায়ের নেতাদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ মেয়াদি এ কর্মসূচির জন্য ১০ লাখ লোক সমাগমের টার্গেট করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, ‘আগামী ২৮ অক্টোবর থেকে সরকার পতনের নতুন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে বিএনপিসহ সমমনা সংগঠনগুলো। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, নির্বাচন কমিশন, সচিবালয়, আদালত ঘেরাও বা এসব প্রতিষ্ঠানের সামনে অবস্থান, মহাসড়ক অবরোধসহ ঢাকার প্রবেশদ্বারগুলোতে অবস্থান কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।’
সূত্র জানায়, এবারের চূড়ান্ত কর্মসূচি হবে গোটা রাজধানীজুড়ে। বিশেষ করে ঢাকার প্রবেশদ্বারসহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো দখলের চেষ্টা থাকবে আন্দোলনকারীদের। কর্মসূচিতে রাজধানীর চার প্রবেশমুখে উত্তরা-গাবতলী এবং সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী ২৫ হাজার করে এক লাখ, মহাখালী-ফার্মগেট-শাহবাগ-নয়াপল্টন এলাকায় এক লাখ করে চার লাখ, আদালত-সচিবালয়-প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে ৫ লাখ— সব মিলিয়ে চূড়ান্ত কর্মসূচিতে ১০ লাখ লোকের সমাগম করতে চায় বিএনপি। চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে অবস্থান নেওয়ার পরিকল্পনা তাদের। রাজপথে অবস্থান নেওয়া নেতাকর্মীদের নিয়মিত খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থার কথাও ভাবা হচ্ছে।
চূড়ান্ত আন্দোলনে সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ
চূড়ান্ত আন্দোলন কর্মসূচি পালনে বেশকিছু সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ নিয়েও ভাবছে বিএনপি। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পশ্চিমাদের অবস্থান, দেড় দশক ধরে নির্যাতিত নেতাকর্মীদের ঘুরে দাঁড়ানো, মাদক, দুর্নীতি এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি— এসব আন্দোলনের জন্য সহায়ক হবে বলে ভাবছে দলটি। অন্যদিকে, পশ্চিমাবিরোধী বলয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিজ্ঞতা-দূরদর্শিতা, রাষ্ট্রযন্ত্র বা পুলিশের গুলিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো নেতাকর্মীর অভাব— প্রভৃতি বিষয় আন্দোলনের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থান করছেন। অন্যদিকে, বিএনপির ঢাকার কেন্দ্রীয় এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো অগোছালো নেতৃত্বের কারণে দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা, নেতৃত্বের সংকট, দলের মধ্যকার নেতাদের সরকারপ্রীতি, শিগগির দলের নেতাদের সম্ভাব্য কারাবাস- সবকিছু বিবেচনায় রেখে চূড়ান্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নের কথা ভাবা হচ্ছে। সবকিছু বিবেচনায় রেখেই আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।’
চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্যসচিব আমিনুল হক বলেন, ‘ঢাকাসহ সারাদেশে দুর্গাপূজার পর আন্দোলন কর্মসূচি আসছে। সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নে দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রয়েছে। এবারের কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি থাকবে।’
গত ২৯ জুলাইয়ের কর্মসূচির মতো আগামী কর্মসূচি যদি ব্যর্থ হয় সেক্ষেত্রে কী হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এবার সেই সুযোগ হবে না। ফুটবলের মতো এবার ‘ডু অর ডাই’ খেলবো। দেশের মানুষ জেগে উঠেছে। গণতান্ত্রিক বিশ্ব তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। এবার আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত।’’
চলমান কর্মসূচিতে দাবি আদায় হবে কি না জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘দুর্গাপূজার পরে নতুন কর্মসূচি আসছে। সেটা গতানুগতিক কর্মসূচি হবে না। কঠিন এবং কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।’
সেই আন্দোলন ব্যর্থ হলে কী হবে- এমন প্রশ্নে আলাল বলেন, ‘সেটা পরে দেখা যাবে। যারা একতরফা নির্বাচনের চেষ্টা করছে, সেটাও আন্দোলন। সুতরাং তারাও তো ব্যর্থ হতে পারে। দেখা যাক।’
চূড়ান্ত কর্মসূচির বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান বলেন, ‘দুর্গাপূজার পর কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে সরকারের পতন ঠেকানো যাবে না।’
বিএনপির দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেন, ‘দুর্গাপূজার ছুটি শেষে যেকোনো দিন থেকে সরকার পতনের লাগাতার কর্মসূচি পালন শুরু হবে। সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত এ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। কর্মসূচির বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, ‘আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়কের দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করা হবে। আন্দোলন চলছে, যথাসময়ে আন্দোলনের ধরন পরিবর্তনে গতি বাড়ানো হবে।’
বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির প্রধান ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘দল আন্দোলনে আছে। সামনে দাবি মানার জন্য সব ধরনের কর্মসূচি আসবে।’
বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘সরকারের পতন ঘটানোর জন্য এক সপ্তাহের আন্দোলন যথেষ্ট। এটা পূজার পর দেখতে পাবেন। হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও সবই দেখতে পারবেন। আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো। সরকারের পতন তফসিল ঘোষণা করা না করার ওপর নির্ভর করে না।’